পাল সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের পরবর্তী ধ্রুপদি যুগের একটি সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের উৎসস্থল ছিল বাংলা অঞ্চল। পাল সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় এই সাম্রাজ্যের শাসক রাজবংশের নামানুসারে। পাল সম্রাটদের নামের শেষে ‘পাল’ অনুসর্গটি যুক্ত ছিল। প্রাচীন প্রাকৃত ভাষায় এই শব্দটির অর্থ ছিল ‘রক্ষাকর্তা’। পাল সম্রাটেরা বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট পদে গোপালের নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে। অধুনা বাংলা ও বিহার ভূখণ্ড ছিল পাল সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এই সাম্রাজ্যের প্রধান শহরগুলি ছিল পাটলীপুত্র, বিক্রমপুর, রামাবতী (বরেন্দ্র), মুঙ্গের, তাম্রলিপ্ত ও জগদ্দল।
পাল সম্রাটরা ছিলেন প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও যুদ্ধজয়ী। তাদের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বৃহৎ যুদ্ধহস্তী বাহিনী। তাদের নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করত। পাল সম্রাটরা ছিলেন ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। তারা একাধিক বৃহদায়তন মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সোমপুর মহাবিহার। তারা নালন্দা ও বিক্রমশিলা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাদের রাজত্বকালেই প্রাচীন বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে। শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য, তিব্বতি সাম্রাজ্য ও আরব আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বাংলা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাল যুগেই বাংলায় প্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। পাল প্রত্নস্থলগুলিতে আব্বাসীয় মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আরব ইতিহাসবিদদের রচিত নথিপত্রেও পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের দেশের বাণিজ্যিক ও বৌদ্ধিক যোগাযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।
খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই সময় পাল সাম্রাজ্যই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। সেই যুগে এই সাম্রাজ্য অধুনা পূর্ব-পাকিস্তান, উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়। পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল সম্রাট ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে। তিব্বতে অতীশের মাধ্যমে পাল সাম্রাজ্য প্রভূত সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাল সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও। উত্তর ভারতে পাল শাসন ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ কনৌজের আধিপত্য অর্জনের জন্য গুর্জর-প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাল সম্রাটরা পরাজিত হন। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তারপর সম্রাট প্রথম মহীপাল বাংলা ও বিহার অঞ্চলে দক্ষিণ ভারতীয় চোল অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেন। সম্রাট রামপাল ছিলেন সর্বশেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট। তিনি কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস প্রাপ্ত হয়।
খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশেষ প্রধান বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। বাংলার ইতিহাসে পাল যুগকে অন্যতম সুবর্ণযুগ মনে করা হয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাল সম্রাটরা বাংলায় স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। পূর্বতন বঙ্গীয় সভ্যতাকে তারা উন্নত করে তোলেন। সেই সঙ্গে শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অসামান্য কীর্তি রেখে যান। তারা বাংলা ভাষার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। বাংলার প্রথম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ পাল যুগেই রচিত হয়েছিল। আজও তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে পাল উত্তরাধিকার প্রতিফলিত হয়।
বিশেষ তথ্যঃ
# বাংলার দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ- পাল বংশ ।
# পাল বংশের রাজারা বাংলায় রাজত্ব করেছেন প্রায় চারশত বছর ।
#পাল বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়- ৭৫৬ সালে ।
# পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা- গােপাল ।
# পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা- ধর্মপাল ।
# সােমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন- ধর্মপাল ।
# সােমপুর বিহার অবস্থিত- নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে।
# বাংলার প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রাজ বংশের নাম- পাল বংশ ।
#বাংলার প্রথম বংশানুক্রমিক রাজবংশ চালু করে- পালরা ।
#দেব রাজাদের রাজধানী দেব পর্বত অবস্থিত- বর্তমান কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে পাল বংশের সর্বশেষ রাজা- মদনপাল ।
# বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হয়- পাল আমলে ।
#দিনাজপুরে রামসাগর দিঘিটি খনন করেন- রামপাল।
# ' রামচরিত গ্রন্থের রচয়িতা- সন্ধ্যাকর নন্দী রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়- রামচরিত ' গ্রন্থে ।
0 Comments