র‍্যাডক্লিফ রেখা (পার্ট ১).

 আমরা অনেকেই জানি না র‍্যাডক্লিফ রেখা কি। হয়তো অনেকে নাম আগে কখন শুনেনি। র‍্যাডকিফ সম্পর্কে জানা অনেক জরুরী কেননা এর পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক ইতিহাস। আর অনেক পরীক্ষায় বা প্রতিযোগিতায়ও র‍্যাডক্লিফ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন এসে থাকে। আশা করি তথ্যগুলো থেকে অনেকেই উপকৃত হবেন। 


র‍্যাডক্লিফ রেখাঃ
 ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির প্রশ্নে যে রেখাটি দ্বারা দুই দেশের সীমান্ত আলাদা করা হয় তাকে র্যাডক্লিফ রেখা বলা হয় । এটি র্যাডক্লিফ কমিশন নামেও খ্যাত । উল্লেখ্য , বাংলাদেশ ও ভারতের | সীমান্তও এ রেখা দ্বারা আলাদা করা হয় । এই রেখা বরাবর ১৯৫২ সালে ভারত | সরকার সীমান্ত পিলার বসালে ছিটমহল  বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
 এই ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভাজন করে নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারনকারী রেখা৷ এটি এই রেখার পরিকল্পক স্যার শেরিল র‍্যাডক্লিফ এর নামে নামাঙ্কিত৷ তিনি প্রায় ৮.৮ কোটি মানুষের বসতি ও সর্বমোট ১,৭৫,০০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃৃত বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় প্রদেশের জনবিন্যাসগত সুষ্ঠু বিভাজন পরিকল্পনার যুগ্মসভাপতি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৭ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারন রেখার অন্তিম পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়৷ বর্তমানে এই রেখাটির পশ্চিমভাগ ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত ও পূর্বভাগ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নামে পরিচিত৷
রেডক্লিফ কমিশন গঠনের পুর্বের ঘটনাবলীঃ
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাইতে যুক্তরাজ্যের আইনসভাতে (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট) পাশ হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনকে নির্দেশ করে, যা একমাস পরে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট ফলস্রুতি পায়৷ শুধু তাই নয় আইনটির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি অধিরাজ্যের মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি ও প্রদেশসমূহ বিভাজনের ইঙ্গিতও নিহিত ছিলো৷
ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় ও আইনানুসারে ভারতের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে দেশীয় রাজ্য এবং ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলগুলি একীভূত করে তাদের নেতৃৃৃবৃৃন্দের ওপর কে কোন অধিরাজ্য চয়ন করবে সেই অধিকার দেওয়া হয়৷
পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিলো একটি মুসলিমপ্রধান ক্ষেত্র তৈরী করা, অপরদিকে ভারতীয় অধিরাজ্য চেয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে৷ ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলিই পরে পাকিস্তানের স্রষ্টা হয়ে ওঠে৷ প্রাথমিকভাবে উত্তরপশ্চিমের বেলুচিস্তান প্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৯১.৮% মুসলিম জনসংখ্যা) ও সিন্ধুপ্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৭২.৭% মুসলিম জনসংখ্যা) পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ উক্ত প্রদেশগুলিতে অন্যান্যধর্মের সংখ্যা নগণ্য হলেও (যদিও সিন্ধুপ্রদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ছিলো হিন্দুপ্রধান) উত্তর পশ্চিমের পাঞ্জাব ও পূর্বভারতের বঙ্গপ্রদেশ ছিলো যথাক্রমে ৫৫.৭% ও ৫৪.৪% মুসলিমপ্রধান৷ পাঞ্জাব প্রদেশ (ব্রিটিশ ভারত)|পাঞ্জাবের পশ্চিমভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় আবার পূর্ব পাঞ্জাব ভারতের একটি রাজ্য হিসাবে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়৷ পরে পূর্ব পাঞ্জাব পাঞ্জাব, হরিয়াণা ও হিমাচল প্রদেশ নামে তিনটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়৷ বঙ্গপ্রদেশও পূর্ব বাংলা (পাকিস্তান) ও পশ্চিমবঙ্গতে (ভারত) বিভক্ত হয়ে যায়৷ স্বাধীনতার পূর্বে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (যা পূর্বে ডুরান্ড সীমার মাধ্যমে আফগানিস্তানের সাথে সীমানা নির্দেশিত ছিলো) গণভোটের মাধ্যমে ঠিক হয় যে তা পাকিস্তানের যাথে যুক্ত হবে৷ এই বিতর্কিত গণভোটটি যদিও পরবর্তীকালে উক্ত প্রদেশে খুদাই খিদমতগার আন্দোলনের মাধ্যমে স্থানীয় পাঠানরা বয়কট করে৷ এটি বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ৷
পাঞ্জাবের ধর্মীয় জনবিন্যাস এমনই ছিলো যেন কোনো রেখার দ্বারাই হিন্দু, মুসলিম ও শিখপ্রধান অঞ্চল আলাদা করা সম্ভব ছিলো না৷ একই কারণে কোনোভাবেই ব্রিটিশ প্রস্তাবিত কোনো সীমা নির্ধারণকারী রেখা মহম্মদ আলি জিন্নাহ পরিচালিত মুসলিম লীগ এবং জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়কে খুশি করতে পারেনি৷ উপরন্তু ধর্মের ভিত্তিতে করা যেকোনো প্রকার বিভাজনের ফলস্বরূপ রেল ও সড়ক বিছিন্ন, সেচ পরিকল্পনা, বৈদ্যুতিন সংযোগ এমনকী ভূসম্পত্তির টানাপোড়ন হওয়া সম্ভাবনা নাকচ করা যেতো না৷ যাইহোক, একটি সুপরিকল্পিত রেখা দ্বারা চাষী ও চাষের জমিকে বা সাধারণ মানুষকে সর্বনিম্ন হয়রানির সম্মুখীন করা যেতো৷
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে উপমহাদেশে প্রায় ১.৪ কোটি জনসাধারণ বাস্তুহারা হয়৷ তারা যে যেমন ভাবে পারুক বাসে, ট্রেনে, আকাশপথে, এক্কাগাড়ি, লরিতে করে এবং অধিকাংশই পায়ে হেঁটে আপন জমিহারা হয়ে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হন৷ তাদের অনেকেই প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়, অনেকে দুর্ভিক্ষগ্রস্থ হয়ে বা অবসন্ন হয়ে মারা যান৷ এছাড়া ঊনপুষ্টি জনিত শরণার্থীদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কলেরা ও আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন৷ উক্ত সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর অনুমোদিত গণনা অনুসারে প্রায় ২,০০,০০০ জন শরণার্থী বিভিন্ন কারণে মারা যায়, যদিও জণগণনার মাধ্যমে জানা যায় যে এর পরিমান প্রায় দশলক্ষের কাছাকাছি ছিলো৷
প্রক্রিয়া ও অবদানকারী ব্যক্তিত্বঃ
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারন করেছিলেন৷ কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে একটি অন্তর্বঙ্গ এবং আরেকটি অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফকে নিয়োগ করেন৷
প্রত্যাসন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নির্ণয় করে সেই ভিত্তিতে পাঞ্জাবের ভারতীয় খণ্ড ও পাকিস্তানি খণ্ড ন্যূনতম প্রতিরোধের সাথে নির্ধারন করার জন্য ভারতে কমিশন গঠন করা হয়েছিলো৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও এই কমিশন অন্যান্য বিষয়গুলিকেও বিবেচনার মধ্যে আনে৷ সামান্য কিছু বিচ্যুতি বাদ দিয়ে অন্যান্য ভিত্তিক বিষয়গুলি সুস্পষ্ট না হলেও র‌্যাডক্লিফ লাইনটি প্রাকৃতিক সীমানা, যোগাযোগ, জলসম্পদ ও সেচকার্যের ওপরেও নির্ভর ছিলো৷ এছাড়া কিছুক্ষেত্রে আর্থসামাজিক বিবেচনার মাধ্যমেও সীমানা ঠিক হয়৷ প্রতি কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন৷ উভয়পক্ষের আগ্রহীদের অচলাবস্থায় বা তাদের হিংসাপূর্ণ আচরণের সময় মাননীয় র‌্যাডক্লিফই অন্তিম সিদ্ধান্ত নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই জুলাই মাসে একটি পক্ষপাতশূণ্য সীমানা নির্ধারণের জন্য র‌্যাডক্লিফ মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন৷ শীঘ্রই তিনি তার মহাবিদ্যালয়ের সহপাঠী মাউন্টব্যাটেনের সাথে কমিশনের সদস্যদের সাথে দেখা করার জন্য লাহোর এবং কলকাতাতে এসে উপস্থিত হন৷ কমিশন সদস্যের মধ্যে মুখ্য দুজন ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের মুখ্য জওহরলাল নেহেরু মহাশয় ও মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ৷ তিনি এতো ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে এরকম বৃৃহত্তর সিদ্ধান্ত নিতে প্রথমে না চাইলেও সমস্ত দলীয় সদস্যরা তার কাছে ১৫ই আগস্টের পূর্বে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন৷ মাউন্টব্যাটেন এইসময়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত ভাইসরয় পদে আসীন থাকতে রাজি ছিলেন পদ প্রত্যাহারের ঠিক দুদিন আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিলো কিন্তু রাজনৈতিক চাপানউতোর ও কুটনৈতিক কারণে স্বাধীনতার ঘোষণার দুদিন পর অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট তারিখে চূড়ান্ত সীমানা ঘোষণা হয়৷

কমিশনের সদস্য পদসম্পাদনাঃ
প্রতি সীমানা নির্ধারণ কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন৷ এছাড়াও পঞ্চম ব্যক্তি হিসাবে উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্বয়ং র‌্যাডক্লিফ
বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক সি.সি.বিশ্বাস এবং বিজন কুমার মুখার্জী এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক আবু সালেহ মুহাম্মদ আক্রম এবং শেখ আব্দুর রহমান৷
পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক তেজ সিং এবং মেহের চাঁদ মহাজন এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক দীন মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ মুনীর৷



Post a Comment

0 Comments