র‍্যাডক্লিফ রেখা( পার্ট ২)।

 


সীমা রচন প্রক্রিয়াসম্পাদনাঃ
বাইরে থেকে আনীত আইনজ্ঞ, র‌্যাডক্লিফ এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য মজুত থাকা ও অভিজ্ঞতা থাকার দরুন অতিরিক্ত কোনো সময় নষ্ট বা প্রতিনিধিদলের প্রয়োজন পড়েনি৷ সীমানা তৈরীর মতো তাদের কাছে কোনো দক্ষ প্রযোজক ও তথ্যপ্রযৌক্তিক ছিলো না৷ তাদের কোনো বিবেচক ও ছিলো না আবার কাজটি একদম নিঁখুতভাবে করার জন্য আঞ্চলিক তথ্য বা জরিপ করার সময়ও ছিলো না৷ দক্ষ অভিজ্ঞ মানুষ ও বিবেচকদের অভাব থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃৃত এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব নেওয়ার চেষ্টা করে৷ ব্রিটেনের নতুন নির্বাচিত শ্রমজীবী সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি, ঋণের বোঝা ও তার টালবাহান সাম্রাজ্যের চাপ নিতে প্রস্তুত ছিলো না৷ বাইরের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে ব্রিটিশরা তাদের বিস্তৃৃত সাম্রাজ্যের ইতি ঘটাতে চান যেমন, তারা অন্যান্য অধিকৃৃত দেশের সাথে করেছিলো৷ একই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তি পায়, সেই পরিস্থিতির পুণরাবৃত্তি হয় ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও৷

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বসম্পাদনাঃ
নিশ্চুপ অবস্থা ত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ উভয়ই সমান প্রতিনিধিত্ব করে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষপাতিত্ব প্রশমিত করতে থাকে৷ তাদের সম্পর্ক এতটাই উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে যে, বিচারকমন্ডলীও তাদের সাথে পৃৃথকভাবে আলোচনা করতে নাকচ করে দেয় এবং বিষয়সুচি এতটাই বিষম হয়ে ওঠে যে কোনো ছোট বিষয়ও বাদ যায়নি৷ বিষম পরিস্থিতি এতটাই বাজে হয়ে ওঠে যে স্বাধীনতার কিছু সপ্তাহ পুর্বে লাহোরে অবস্থানরত এক শিখ বিচারকের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হয়৷

কার্যত, বিপক্ষ দলের হিন্দু এবং মুসলিম সদস্য সংখ্যালোপ করার জন্য পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে৷ প্রসঙ্গত পরিস্থিতি এমন হয় যে, পাঞ্জাবে সীমানা কমিশনকে একটি শিখপ্রধান অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে ভাগ করতে হয়৷ লর্ড ইসলায় ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজদের সহায়ক চমৎকার ভারতীয় সৈন্যদল"কে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কিন্তু তা ছিলো ব্রিটিশদের অন্যতম ঐতিহাসিক ভুল৷ যাইহোক, শিখ সৈন্যদল কোনোভাবেই তাদের সম্প্রদায় একটি মুসলিমপ্রধান দেশের জন্য যুদ্ধ করুক তা চায়নি, ফলে তারা ভারতে থাকতে চায়৷ উপরন্তু ভারতে যুক্ত না হলেও তাদের অনেকে আলাদা রাষ্ট্রের দাবী করেছিলো যা ব্রিটিশরা ও কমিশন কোনোভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি৷

পরিশেষে, অন্যান্য সম্প্রদায়গুলির ভাগ্য প্রতিনিধির অভাবে বাকী দলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে৷ বাংলা সীমানা কমিশন প্রতিনিধিরা কলকাতা শহর কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে সেই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে৷ আবার উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের তরফ থেকে কমিশনে কোনো সদস্য ছিলো না৷ তারা ভারতভাগের দুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সমস্ত তথ্য থেকে রহিত ছিলো ফলে তারা কোনো সদস্যপদের আবেদনও করার সুযোগ পায়নি৷

এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেও সীমানা নির্ধারণ আশু প্রয়োজনীয় দেখে র‌্যাডক্লিফ নিজেই সমস্ত গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেন৷ শুরুতে সবকিছু পর্যালোচনা করা অসম্ভব ছিলো কিন্তু র‌্যাডক্লিফ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং আবার নতুন করে বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে ভেবে এরপর কোনোপ্রকার পরিবর্তন করার কথা খারিজ করে দেন৷

স্থানীয় জ্ঞানঃ
কার্যনিযুক্তির পুর্বে র‌্যাডক্লিফ কখনো ভারতে কার্যসুত্রে বা ভারত পরিদর্শনে আসেননি ফলে তিনি স্থানীয়দের কাছে যেমন অপরিচিত মুখ ছিলেন তেমনি তারও ভারত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিলো না৷ ব্রিটিশদের এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিতর্কের পরেও পক্ষপাতহীনত্বই এই প্রকল্পের মুল সম্পদ ছিলো৷ ব্রিটেন ছাড়া অন্য যেকোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না এই শর্তেই তিনি নিযুক্ত হন৷  তার ব্যক্তিগত মুনশী ক্রিস্টোফার ব্যুমন্ট পাঞ্জাবের প্রশাসন ও জীবনশৈলীর সাথে পরিচিত ছিলেন৷ নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য র‌্যাডক্লিফ; ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথেও দূরত্ববজায় রাখতে থাকেন৷ 

দ্বন্দ্ব এড়িয়ে থাকা যাবে এরকম সীমানা নির্ধারণ করার মতো বিচক্ষণতা বা পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিলো না৷ পাঞ্জাব এবং বাংলায় আগেই হয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশদের ভারত বিদায়কে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছিলো৷ উপনিবেশ পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়া কী ধরনের অসাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানি হতে পারে তার আভাষ অর্ধশতাব্দী পুর্বেই উপ্ত হয়েছিলো৷ উপমাহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও করদ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন ছিলো ফলে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের হাতের শতাব্দীর দুঃখজনক এই বিভাজনের ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে৷

ত্বরা এবং ঔদাসীন্যসম্পাদনাঃ
র‌্যাডক্লিফ স্বতঃসিদ্ধ সত্যতার সাথে নৈমিত্তিক বিভাজন করাকে ন্যায্য বলে ভেবেছিলেন যদিও তাতে বহুলোককে সাম্প্রদায়িকভাবে ভুক্তভোগী হতে হতো৷ র‌্যাডক্লিফ ভারত ছাড়ার আগে তার সমস্ত নথিপত্র বিনষ্ট করে দেন তাই এই যুক্তির পেছনে র‌্যাডক্লিফের চিন্তাভাবনা জানা যায় না৷ সীমান্ত তৈরীর পরিকল্পনা সম্পন্ন করে তা লাগু হওয়ার আগেই তিনি নিজে থেকে ভারতের স্বাধীনতার দিন ভারত থেকে বিদায় নেন৷ র‌্যাডক্লিফের স্ব-উক্তিতে বলেন যে ভারতীয় জলবায়ু তার শরীর পক্ষে উপযুক্ত না৷ তার তাড়াতাড়ি ভারতত্যাগের এই কারণটিই তিনি জনসমক্ষে পেশ করেন৷ 

সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া যতটা দ্রুততার সাথে নেওয়া হয়েছিলো তার বাস্তবায়ন ও করা হয় সেরকমই দ্রুততার সাথে কোনো বিবেচনা ছাড়া৷ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট র‌্যাডক্লিফের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিন ১৬ই আগস্ট তারিখে বিকাল ৫টার সময় ঐ পরিকল্পনাটি ভারতীয় ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পড়ার জন্য দুঘণ্টা সময় দেওয়া হয়৷

গোপনীয়তাসম্পাদনাঃ
মতবিরোধ এবং বিলম্ব এড়ানোর জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৯ই এবং ১২ই আগস্ট-এর মধ্য পরিকল্পনা মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেলেও তা স্বাধীনতার দুদিন পর আনা হয়, তার আগে নয়৷

রিড এবং ফিশারের মতে, কিছু পরিস্থিতিগত প্রমাণ এও পাওয়া যায় যে মাউন্টব্যাটেন বা রেডক্লিফের ভারতীয় সহকারী পারিষদের সদস্যরা ৯ বা ১০ই আগস্টে পাঞ্জাবের প্রদেশ বিভাজন ও তার রূপায়ণ সম্বন্ধ্যে সমস্ত গোপন তথ্য নেহরু ও প্যাটেলকে ফাঁস করে দেয়৷ এই গোপন সংবাদ কীভাবে প্রকাশ হলো সেই বিষয়ে চিন্তা না করে পরিবর্তনস্বরূপ শতদ্রু খালকে পাকিস্তানে না দিয়ে ভারতের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয় যা শতদ্রু নদীর পূর্বদিকের প্রাচীরের কাজ করবে বলে মনে করা হয়৷ এই অঞ্চলে পাঁচলক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার সাথে দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিল রয়ে যায়। এই পরিকল্পনা পরিবর্তনের দুটি কারণকে তুলে ধরা যেতে পারে যে, এই অঞ্চলে একটি সেনাবলের অস্ত্রদপ্তর ছিলো এবং এটি ছিলো শতদ্রু খালের মুখ, যা সমগ্র বিকানের রাজ্যের জলপ্রাপ্তির অন্যতম উৎস৷ ভারতের মরু অঞ্চলগুলিতে এই সেচখালের মাধ্যমেই চাষাবাদ হতো৷

রূপায়ণসম্পাদনাঃ
দেশ ভাগের পরে, ব্রিটিশ সরকার দেশত্যাগ করলে সীমানা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের ওপর পড়ে৷ আগস্ট মাসে লাহোর পরিদর্শনের পরে ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আসন্ন দাঙ্গা আটকানোর জন্য শীঘ্রভাবে পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স (পাঞ্জাব সীমানারক্ষা বল) মোতায়েন করেন৷ কিন্তু ৫০,০০০ লোকবল যুক্ত এই সেনাদল ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড আটকানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিলো না৷ ৭৭% হত্যাকাণ্ডই হয়েছিলো পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলগুলিতে৷ প্রদেশটির আয়তনানুসারে লোকবল এতই কম ছিলো যে প্রতিবর্গমাইলেও একজন করে সেনা গোনা যেত না৷ পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা ও দুর্ঘটনার শিকার হয় প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা হয়ে দেশান্তরী হন, এই বিপুর পরিমান বিশৃঙ্খলা আটকানোর ক্ষমতা ঐ সামান্য সেনাবাহিনীর ছিলো না৷

ভারত এবং পাকিস্তান কেউই চুক্তি ভাঙতে রাজি ছিলো৷ তারা নির্ধারিত সীমানার উভয়দিকের গ্রামগুলিতে আসন্ন বিদ্রোহর কথা মাথায় রেখে তা প্রশমনে তৎপর হয়, নয়তো এই বিষয়টির ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে উভয় দেশকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে ফলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পড়তে পারে৷ সীমানা বিতর্ক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে তিনবার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছিলো এবং পরবর্তী কালে ১৯৯৯ তে কার্গিল যুদ্ধও ছিলো বিতর্কিত সীমানা কলহেরই ফল৷

Post a Comment

0 Comments